প্রকাশ ঘোষ বিধান
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কপিলমুনি যুদ্ধ এক বিরল ঘটনা। কপিলমুনি দক্ষিণ খুলনা তথা পাইকগাছার একটি প্রাচীন জনপদ। কপিলমুনির রূপকার ও স্থপতি ছিলেন রায়সাহেব বিনোদবিহারী সাধু। কপিলমুনি জুড়ে তাঁর স্মৃতি বিদ্যমান। কপিলমুনি ছিল রাজাকারদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়িতে তারা ঘাঁটি গেড়েছিল। এটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিত ছিল।
১৯৭১ সালের মে মাসের দিকে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী আমির মাওলানা এ কে এম ইউসুফের নেতৃত্বে পাকিস্তানের অখ-তা ও খানসেনাদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে খুলনা শহরের খানজাহান আলী রোডের আনসার ক্যাম্পে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এর দায়িত্বে ছিল জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ। দেশের অন্যান্য স্থানেও রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। কপিলমুনিতে ২শ’ জনেরও বেশি রাজাকার নিয়ে তারা বিনোদবিহারী সাধুর বাড়িতে ক্যাম্প গঠন করে। কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন আফসার শিকারি নামে এক ব্যক্তি।
কপিলমুনি ছিল রাজাকারদের দুর্গ এবং শক্তিশালী ঘাঁটি। বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে এই রাজাকার ঘাঁটিটি ছিল সবচেয়ে বড় এবং ভয়ংকর। এ ঘাঁটির মাধ্যমে কপিলমুনি, তালা, ডুমুরিয়াসহ খুলনা ও সাতক্ষীরার বিশাল অংশ রাজাকাররা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। দুইশ’র বেশি রাজাকার ও আলবদর ছিল সশস্ত্র অবস্থানে। সুবিশাল দোতলা ভবন, চারদিকে উঁচু প্রাচীর অনেকটা মোগল আমলের দুর্গের মতো। বাড়িটি ছিল রাজাকার ও আলবদরদের দুর্ভেদ্য ঘাটি। কপোতাক্ষ তীরে ১২ ফুট উঁচু ও ৩ ফুট প্রস্থের প্রাচীর বেষ্টিত ২টি লোহার কলাপসিবল গেট দ্বারা সুরক্ষিত বহু কক্ষবিশিষ্ট দ্বিতল প্রাসাদ। রাজাকাররা বিনোদ বিহারী সাধুর সুরক্ষিত দ্বিতল ভবনটি নিরাপদ দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলে। রাজাকাররা কপিলমুনি বাজার থেকে শত শত বস্তা চাল, ডাল, আটা, ময়দা, ঘি তেলসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু লুট করে ওই বাড়ির একটি কক্ষে বোঝাই করতো। কাশিমনগর হাট ও এলাকা থেকে পছন্দের গরু ছাগল ধরে আনতো। রাজাকারদের বাদশাহী কায়দায় খানাপিনা তৈরি ও আপ্যায়নের কাজে চারজন বাবুর্চি ছিল।
প্রথমদিকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের, তারপর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা ও নির্যাতন করতো। ক্যাম্প স্থাপনের পর প্রথমেই তারা ডা. ফণিভূষণ নাথ, উমাপদ দে ও চৈতন্য মল্লিককে ধরে এনে কপিলমুনি বাজারের ফুলতলা নামক স্থানে কপোতাক্ষ নদের ঘাটে হত্যা করে পানিতে ভাসিয়ে দেয়। বহু হিন্দুকে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে। যখন তখন যাকে তাকে ধরে এনে ইচ্ছামতো হত্যা করতো। স্থানীয় মুসলিম লীগ ও শান্তি কমিটির সদস্যদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী তারা এলাকার বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতো, হিন্দু নারীদের ধরে এনে ধর্ষণ করে হত্যা করতো। রাজাকার কমান্ডার নারীদের ভোগ করার পর অন্য রাজাকাররা ভোগ করতো।
ঐ ক্যাম্পে ৬টি কক্ষ নির্ধারিত ছিল ধর্ষণ ও অত্যাচারের জন্য। অনেক নারীকে ধর্ষণের পর পেট চিরে নদীর পানিতে ফেলে দিত। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে রত্না নামের একটি মেয়েকে সারারাত অত্যাচার করার পর তাকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিলে তার ভাসমান লাশ দেখে স্থানীয় মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
সুরক্ষিত দুর্গে বসে চলতো তাদের অত্যাচার। জোর করে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী আনা তাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। এলাকাটিতে হিন্দুদের বসবাস বেশি থাকায় তাদের ওপর চলতো অমানবিক নির্যাতন, ধন-সম্পদ লুট এমনকি জোর করে তাদের অনেককেই ধর্মান্তরিত করা হতো। হত্যা করা হয় শত শত মানুষকে। লালসার শিকার হন অগণিত মা-বোন। তাদের নির্যাতনের মাত্রা এতটা ভয়াবহ ছিল যে, আজো সে দিনের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকেই গা শিউরে ওঠেন। মানুষ ধরে দেয়ালে পেরেক দিয়ে শরীর গেঁথে রাখা হতো। হাত-পা কেটে ছিটানো হতো লবণ। এমনকি বড় বড় ইট দিয়ে শরীরে আঘাত করে হত্যা করা হতো। নির্যাতন করে হত্যার পর গোপন সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে লাশ পাশের কপোতাক্ষ নদে ফেলে দেয়া হতো। এই ক্যাম্পের রাজাকাররা খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করেনি। তারা ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন বের হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে গিয়ে গ্রামের নিরীহ মানুষকে ধরে এনে অত্যাচার করতো। এলাকার উঠতি বয়সের যুবতী মেয়েদের ধরে এনে ক্যাম্পে অত্যাচার করা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে পড়েছিল। রাজাকাররা হিন্দু আর বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতো। রাজাকার বাহিনীর আগমনের সংবাদ শুনলে এলাকার নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, যুবক সবাই পালিয়ে যেত।
এই কপিলমুনিকে স্বাধীন করতে স. ম আলাউদ্দীনের অবদান চিরস্মারণীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের যে কয়েকজন সদস্য সরাসরি অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলেন তাদেরই অন্যতম স. ম আলাউদ্দীন। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৬৭ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ২৯৮ জন নির্বাচিত সদস্যের প্রায় সকলেই ভারতে চলে যান। এরমধ্যে ৯ জন সদস্য অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স. ম আলাউদ্দীন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ভারতে বিহার প্রদেশে চাকুলিয়ার সিএনসি বিশেষ টিমে ৬ সপ্তাহের যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ঐ বিশেষ টিমে তিনিসহ ১৪জন এমএনএ, এমপি এবং ৩ জন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া ও বরিশাল নিয়ে এফ সেক্টর গঠিত হয়। এফ সেক্টর কমান্ডার ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। আমির হেসেন আমুর দায়িত্ব ছিল বনগাঁ থেকে বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে ছেলেদের বাছাই করা। আমির হেসেন আমুর পক্ষে স. ম আলাউদ্দীন ভারতের বসিরহাটে একটি হোটেলে রিক্রুটিং অফিস করেন। তিনি বাগু-িয়া ও ইটিন্ডা ক্যাম্পে নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নিয়োজিত হন। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে টাকি, তকিপুরসহ বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ছেলেদের খোঁজ খবর নিতেন। তিনি নেতৃস্থানীয় ছেলেদের তাদের নিজস্ব সীমান্তে গিয়ে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। মুজিব বাহিনীর কয়েকটি গ্রুপের ট্রেনিং শেষ হয়ে যাওয়ায় পর সাতক্ষীরা মহকুমার বিপুল সংখ্যক গেরিলা নিয়ে তিনি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। কপিলমুনি থেকে নয় কিলোমিটার দূরে তালা থানার মাগুরা ইউনিয়নের মাদরা গ্রামে ছিল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর একটি শক্তিশালী কমান্ড এই গ্রামটি নিরাপদ জেনে ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। কমান্ডার ছিলেন খুলনা জেলার মুজিব বাহিনী উপপ্রধান ইউনুস আলী ও তালা থানা মুজিব বাহিনীর প্রধান মোড়ল আব্দুস সালাম। দুইজনই ভারতের দেরাদুন থেকে বিশেষ গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত। দুই কমান্ডারের একান্ত প্রচেষ্টায় দুই মাসের মধ্যে তালা থানার ১২টি ইউনিয়নে দুই শতাধিক গেরিলা যোদ্ধা তৈরি হয়। গেরিলাদের অস্ত্র সরবরাহ করেন মুক্তিযোদ্ধা ও বৃহত্তর খুলনা জেলার মুজিব বাহিনী প্রধান কামরুজ্জামান টুকু ও তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য স. ম আলাউদ্দীন।
রাজাকারদের প্রধান কাজ ছিল এলাকা থেকে সুন্দরী যুবতী মেয়েদের ধরে আনা ও তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালানো। নারী নির্যাতনের কক্ষের পাশে একটি ছোট রুমে আওয়ামী লীগ কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে শারীরিক অত্যাচার করে গোপন তথ্য বের করার টর্চারিং সেল ছিল। নির্যাতনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের রুমের দেয়ালের সাথে হাতে, পায়ে, মাথায় ও বুকে বড় বড় লোহার পেরেক বিদ্ধ করে নির্মমভাবে খুন করতো। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধা রুস্তমের দেহ পেরেকবিদ্ধ অবস্থায় দেওয়ালের গায়ে পাওয়া যায়।
রাজাকারদের অপারেশন ডায়েরি থেকে জানা যায়, ১৪শ’ ১৩ জন মানুষকে তারা খুন করেছিল। রাজাকারদের আগ্নেয়াস্ত্র বলতে রাইফেল ছাড়া আর কিছু ছিল না। তবে টিন দিয়ে বড় ব্যারেল তৈরি করে কালো রঙ করে কামানের মতো ডামি কামান বানিয়ে ছাদের উপর পেতে রেখেছিল। ছাদের উপর বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার করা ছিল। মনে হতো ছাদের উপর কামান পাতা আছে, বাইরে থেকে দেখে সবাই দারুণ ভয় পেতো।
মুক্তিযোদ্ধারা সেখানকার রাজাকারদের বিরুদ্ধে আগেও দু’তিনবার লড়াই করেছে; কিন্তু তাদের হারাতে পারেনি। মুক্তিবাহিনী ১১ জুলাই কপিলমুনিতে প্রথম আক্রমণ চালায়। আরেকবার তালা থানার বাম সংগঠনসমূহের সমবেত চেষ্টায় রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করা হয়। কিন্তু পর পর দুটি আক্রমণে আশানুরূপ ফল না হওয়ায় রাজাকারদের মনোবল বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই শত্রু মনে করে যে কোনো লোককে রাজাকাররা প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে ক্ষমতার দাপট প্রকাশ করতো। এক পর্যায়ে তাদের অত্যাচারে এলাকার মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে।
রাজাকারদের অত্যাচারের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, এলাকার মুক্তিযোদ্ধাগণ এই ক্যাম্প ধ্বংস করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কপিলমুনির এ শক্ত রাজাকার দুর্গ আক্রমণের জন্য তৈরি করা হয় মহাপরিকল্পনা। এবার আঁটসাঁট বেঁধেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হয়। আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয় এলাকার বিভিন্ন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয় করে। সংকল্প হয় ঐ ঘাঁটির পতন না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের। কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প পতনের এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মুজিব বাহিনীর খুলনার উপপ্রধান ইউনুস আলী, নৌ কমান্ডো দলের লে. রহমতউল্লাহ, স. ম বাবর আলী, লে. শামসুল আরেফিন, স. ম আলাউদ্দীন, ইঞ্জিনিয়ার মুজিবুর রহমান প্রমুখ। এদের নেতৃত্বে খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন থানার কয়েকশ’ মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে অংশ নেন।
৭১ এর ২০ নভেম্বর কপিলমুনি যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন কমান্ডার ইউনুস আলী ও মোড়ল আব্দুস সালাম। এই পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান, সামছুর রহমান, জয়নুল, সুভাষ সরকার, মকবুল ইসলাম, নির্মল পাল, আবু বকর মোড়ল, শরিফুল ইসলাম ও আব্দুর রাজ্জাক। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রধান নেতৃবর্গ ও কমান্ডারদের সমন্বয়ে এক জরুরী বৈঠক আহবান করা হয়। মাগুরার প্রখ্যাত জমিদার অজয় রায় চৌধুরী ওরফে ঝুনু বাবুর দোতলায় রুদ্ধদার বৈঠক হয়। আলোচনায় কপিলমুনি যুদ্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ তারিখ নির্ধারণ করা হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু, স. ম বাবর আলী, স. ম আলাউদ্দীন, সুভাষ সরকার, মুজিবর রহমান, সামছুর রহমান, মাস্টার সুজাত আলী, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। উক্ত বৈঠকে মূল ভূমিকায় ছিলেন কমান্ডার ইউনুস আলী ইনু ও মোড়ল আব্দুস সালাম। রাজাকারদের অস্ত্র ও জনবল সম্পর্কিত গোপন সংবাদ সরবরাহের দায়িত্ব প্রদান করা হয় সরদার ফারুক আহম্মদ ও চেয়ারম্যান নুর খাঁর উপর। কপিলমুনি যুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তানি নৌ-বাহিনীর লে. গাজী রহমত উল্লাহ দাদুকে প্রধান কমান্ডার নির্ধারণ করা হয়। তার নির্দেশে যুদ্ধ চলবে এবং যুদ্ধ শেষ হবে। ব্যতিক্রম হলে রেহাই পাবে না কোনো মুক্তিযোদ্ধা। দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুজিব ও মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত কমান্ড। সকলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কপিলমুনির রাজাকার বাহিনীকে সমূলে নিধন করে তবেই ফিরবে। কপিলমুনিতে বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়ির মূল ভবনের দেয়াল ছিল ২০ ইঞ্চি গাঁথুনির আর সীমানা প্রাচীর ছিল ১৫ ইঞ্চির। এরপরও রাজাকাররা তাদের ঘাঁটির নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য বড় বড় সুন্দরী গাছ দিয়ে একটি প্রাচীর গড়েছিল। বিল্ডিংয়ের ছাদের চারকোণে চারটি বাঙ্কার তৈরি করেছিল রাজাকাররা। উপর থেকে অনেক দূর পর্যন্ত গুলি চালানো যেত। সব মিলিয়ে ভবনটি এতই সুরক্ষিত ছিল যে, সেখানে আক্রমণ চালানো অত্যন্ত দুরূহ ছিল। এ কারণে এমনভাবে পরিকল্পনা সাজানো হয় যাতে রাজাকারদের পরাজয় নিশ্চিত হয়।
পাটকেলঘাটা ব্রিজের পাশে খানসেনাদের ঘাঁটি ছিল। আর গ্রামে ছিল তাদের রাজাকার গোয়েন্দাবাহিনী। কখন কে যুদ্ধে যাচ্ছে এই খবর তাদের কানে পৌঁছালে পাটকেলঘাটায় তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো এবং সেখানে তাদের হত্যা করা হতো। মাগুরা গ্রামের অজয় রায় চৌধুরী ওরফে ঝুনু বাবু ও তার ১৫ জন সঙ্গী ভারতে ট্রেনিং এর জন্য যাচ্ছিল। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ইসলামকাটি পৌঁছানো মাত্র রাজাকারদের আল শামস বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তাদের সবাইকে পাটকেলঘাটা ডাক বাংলায় নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চাঁদকাটী গ্রামের করিম গাজীকে এভাবে মারা হয়।
৫ ডিসেম্বর ৯ নম্বর সাব সেক্টর কমান্ডার লে. কমান্ডার রহমতউল্লাহ্ দাদু ভাইকে প্রধান ও স. ম. বাবর আলী, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, ইউনুচ আলী, স. ম আলাউদ্দীন, আবুল কালাম আজাদকে কপিলমুনির যুদ্ধে সহনেতৃত্ব প্রদান করা হয়। পাইকগাছা থানার কাটিপাড়া ক্যাম্পে লে. কমান্ডার রহমতউল্লাহ্ দাদু ভাই উপস্থিত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রিফিং করেন। অন্যদিকে তালা থানার মাদরা ক্যাম্পে ইউনুচ আলী ব্রিফিং করেন।
কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল চতুর্মুখী। কপিলমুনি যুদ্ধে পরিকল্পনানুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা ৬ ডিসেম্বর ১০ জন কমান্ডারের নেতৃত্বে ১৮টি দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন পথে রাত ১২টায় মাগুরা থেকে কপিলমুনিতে রওনা দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে রাইফেল, এসএলআর মর্টার, অটোমেটিক রাইফেলসহ প্রচুর গোলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। সিদ্ধান্ত ছিল শেষ রাতে মর্টারের গোলা নিক্ষেপের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হবে। কিন্তু কমান্ডার স. ম বাবর আলীর গ্রুপ সোনাতনকাটী খেয়া পার হয়ে নাসিরপুর ব্রিজের সন্নিকটে পৌঁছালে ১৪ জন ডিউটিরত রাজাকারের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ মাঠের সংকেত দ্বারা অভিহিত করা হয়। কিন্তু শত্রু পক্ষের লোক বিধায় সংকেতের জবাব দিতে ব্যর্থ হলে স. ম বাবর আলীর হাতে এলএমজির ব্রাশ ফায়ারে ১৪ জন রাজাকার ঘটনাস্থলে নিহত হয়। এই ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ অসুবিধা ও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। যদিও তাতে কোনো আত্মঘাতি ঘটনা ঘটেনি।
পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে জলে ও স্থলে পাহারায় বসানো হয়, যাতে রাজাকারদের সহায়তার জন্য কোনো পাকিস্তানি সেনা না আসতে পারে। মূল ঘাঁটির পশ্চিম দিকে বেড়িবাধের পাশে নৌ কমান্ডোরা অবস্থান নেয়। ঐ দিন দিবাগত রাতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। রাত ১২টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা যার যার অবস্থানে পজিশন গ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা হরিঢালী স্কুল, কপিলমুনি গার্লস স্কুল, কপিলমুনি বিদ্যামন্দির, নদীর ওপার কানাইদিয়া, গোলাবাড়ী স্কুলসহ বিভিন্ন স্থানে রাজাকার ক্যাম্প ঘিরে অবস্থান গ্রহণ করেন। রাত ৪টার দিকে দাদু ভাই এসএমজি দিয়ে ফায়ার ওপেন করেন। রাজাকার ক্যাম্প লক্ষ করে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি শুরু করেন। রাজাকাররাও বাঙ্কার থেকে গুলি করতে থাকে।
মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে সাড়াশি আক্রমণ শুরু করে রাজাকারদের মূল ঘাঁটিতে। ডিনামাইট দিয়ে কপিলমুনি ও তালার মধ্যবর্তী কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়া হয়। রাস্তায় মাইন বসিয়ে গেরিলারা এম্বুশ পেতে রাখে। টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়। পাকসেনারা এসে যাতে কপিলমুনির রাজাকারদের সহায়তা করতে না পারে সেজন্য কানাইদিয়া গ্রামের রাস্তার কালভার্ট উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। স. ম আলাউদ্দীনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল অবস্থান নেয় রাস্তার পাশে তৈরি করা পরিখায়। তাদের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা আসছে বুঝতে পারলে কালভার্ট উড়িয়ে দেয়া। এই স্থানে কার্ট অফ পার্টির কমান্ডার ছিলেন স. ম আলাউদ্দীন। তবে পাকিস্তানি সৈন্যরা না আসায় সেটার প্রয়োজন পড়েনি।
৬ ডিসেম্বর ভোর হয়। এই দিন ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে মুক্তিযোদ্ধারা নতুন করে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পান। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির সংকট দেখা দিলে কমান্ডারগণ ভারত থেকে গুলি এনে সেই চাহিদা পূরণ করেন। রাজাকাররা ক্যাম্পে আটক থেকে মাঝেমধ্যে গুলি করতে থাকে। বিরামহীন যুদ্ধ চলতে থাকে। তবে আরসিএল এর শত শত গোলা নিক্ষেপ করেও রাজাকার দুর্গের একটি ইটও খসানো যায়নি। এমতাবস্থায় যুদ্ধ শুরুর পরের দিন মাইকে রাজাকারদের নির্দিষ্ট সময় বেধে দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। কিন্তু তার জবাবে তারা আত্মসমর্পণ না করে বাড়ির ভিতর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে অশ্রাব্য গালিগালাজ ও আত্মসমর্পণ করতে বলে। এমনকি রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন প্রকার হুমকি প্রদানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিতে থাকে। এ ঘোষণা শুনে মুক্তিযোদ্ধাদের মেজাজ চরমে উঠে যায়। তারা আমরণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।
একইভাবে ৭ থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ক্যাম্পের মধ্যে অবস্থান করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আত্মসমর্পণ করতে বার বার মাইকযোগে আহ্বান জানানো সত্ত্বেও তারা আত্মসমর্পণ করেনি। ক্যাম্পের মধ্য থেকে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে থেমে থেমে গুলি করতে থাকে। রাজাকারদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে এলে বাঁচার কোনো পথ নেই দেখে রাজাকাররা দুর্বল হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে স. ম আলাউদ্দীন ভারত থেকে মর্টার ও প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে আসছে জানতে পেরে রাজাকারদের মনোবল আরো ভেঙে পড়ে।
রাজাকারদের বাইরের সহায়তা পাওয়ার সব আশা শেষ হয়ে গেলে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে গেলে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত হয়। ৯ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় তারা আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা একে একে সব রাজাকারকে ক্যাম্প থেকে বের করে আনেন। ক্যাম্পের মধ্যে চার জন বীরাঙ্গনাকে পাওয়া যায়। তাদের আটকে রেখে রাজাকাররা অমানুষিক নির্যাতন করেছে। তালার মাছিয়াড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আলী গাজীকে দেওয়ালের সঙ্গে পেরেক দিয়ে বিদ্ধ অবস্থায় ক্যাম্পের মধ্যে পাওয়া যায়। রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করলে এলাকার মানুষ ‘জয়বাংলা’ বলে একত্রিত হয় স্কুলের মাঠে। হাজার হাজার উত্তেজিত জনতা রাজাকারদের মেরে ফেলার দাবি করে। যে যেভাবে পেরেছিল আক্রমণ করেছিল রাজাকারদের ওপর। তারা রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করতে থাকে। স্বজনহারা লোকজন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে ওঠে। জনগণের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ একত্রিত হয়ে রাজাকারদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এলাকার মানুষের দাবি অনুযায়ী গণ-আদালত গঠন করে তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ১৫১ জন (ভিন্ন মতে ১৫৬ রাজাকার) রাজাকারের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি অত্যাচার করেছে, তাদের আলাদা করে এবং অন্যদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। যা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ইতিহাসে ব্যতিক্রমধর্মী অধ্যায়। বাস্তবায়িত হয় গণআদালতের রায়। কপিলমুনি যুদ্ধে দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। বাজারের প্রধান সড়ক পার হতে গিয়ে রাজাকারদের গুলিতে কেয়ারগাতির আনসার আলী ও খুলনার আনোয়ার শহিদ হন। আগরঘাটার মুক্তিযোদ্ধা তোরাব আলী আহত হন। এই ক্যাম্প পতনের পর সেখান থেকে প্রাপ্ত কাগজপত্র থেকে জানা যায় রাজাকাররা ১৬০১ মতান্তরে ১৬১০ জনকে হত্যা করে। তবে জুন-জুলাই মাস থেকে শুরু করে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই দীর্ঘসময়ে এই বিশাল ঘাঁটি থেকে কমপক্ষে ৫ হাজার মানুষকে রাজাকাররা নির্মমভাবে হত্যা করে।
কপিলমুনি যুদ্ধের পরিকল্পনা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. গাজী রহমত উল্লাহ দাদু, স. ম বাবর আলী, ইউনুস আলী, স. ম আলাউদ্দীন, মোড়ল আব্দুস সালাম, সাহিদুর রহমান কুটু, আবুল কালাম আজাদ, গাজী রফিকুল ইসলাম, কামরুজ্জামান টুকু, রশীদ, মকবুল হোসেন, সামাদ মাস্টার, জিল্লুর রহমান, গাজী আনছার খালেক, মোশারফ, আবু জাফর, খোকা, জোয়াদ্দার রসুল বাবু, ইঞ্জিনিয়ার মুজিবুর রহমান, ফারুক সরদার, তোরাব, কাইয়ুম, বিনয়, তৌফিকসহ বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের অবদান চির স্মরণীয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীরসেনানী ও তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা স. ম আলাউদ্দীন ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তালা আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। তালার মাগুরা ও কপিলমুনি যুদ্ধে স. ম আলাউদ্দীনের অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অবদান চির স্মরণীয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, দৈনিক পত্রদূতের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নির্ভীক কলম সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ স. ম আলাউদ্দীনের প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
(তানজির কচি সম্পাদিত ও ম্যানগ্রোভ প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ দীপ্ত আলাউদ্দীন থেকে উদ্ধৃত)
কপিলমুনি যুদ্ধ ও স. ম আলাউদ্দীন
প্রকাশ ঘোষ বিধান
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কপিলমুনি যুদ্ধ এক বিরল ঘটনা। কপিলমুনি দক্ষিণ খুলনা তথা পাইকগাছার একটি প্রাচীন জনপদ। কপিলমুনির রূপকার ও স্থপতি ছিলেন রায়সাহেব বিনোদবিহারী সাধু। কপিলমুনি জুড়ে তাঁর স্মৃতি বিদ্যমান। কপিলমুনি ছিল রাজাকারদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়িতে তারা ঘাঁটি গেড়েছিল। এটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিত ছিল।
১৯৭১ সালের মে মাসের দিকে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী আমির মাওলানা এ কে এম ইউসুফের নেতৃত্বে পাকিস্তানের অখ-তা ও খানসেনাদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে খুলনা শহরের খানজাহান আলী রোডের আনসার ক্যাম্পে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এর দায়িত্বে ছিল জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ। দেশের অন্যান্য স্থানেও রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। কপিলমুনিতে ২শ’ জনেরও বেশি রাজাকার নিয়ে তারা বিনোদবিহারী সাধুর বাড়িতে ক্যাম্প গঠন করে। কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন আফসার শিকারি নামে এক ব্যক্তি।
কপিলমুনি ছিল রাজাকারদের দুর্গ এবং শক্তিশালী ঘাঁটি। বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে এই রাজাকার ঘাঁটিটি ছিল সবচেয়ে বড় এবং ভয়ংকর। এ ঘাঁটির মাধ্যমে কপিলমুনি, তালা, ডুমুরিয়াসহ খুলনা ও সাতক্ষীরার বিশাল অংশ রাজাকাররা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। দুইশ’র বেশি রাজাকার ও আলবদর ছিল সশস্ত্র অবস্থানে। সুবিশাল দোতলা ভবন, চারদিকে উঁচু প্রাচীর অনেকটা মোগল আমলের দুর্গের মতো। বাড়িটি ছিল রাজাকার ও আলবদরদের দুর্ভেদ্য ঘাটি। কপোতাক্ষ তীরে ১২ ফুট উঁচু ও ৩ ফুট প্রস্থের প্রাচীর বেষ্টিত ২টি লোহার কলাপসিবল গেট দ্বারা সুরক্ষিত বহু কক্ষবিশিষ্ট দ্বিতল প্রাসাদ। রাজাকাররা বিনোদ বিহারী সাধুর সুরক্ষিত দ্বিতল ভবনটি নিরাপদ দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলে। রাজাকাররা কপিলমুনি বাজার থেকে শত শত বস্তা চাল, ডাল, আটা, ময়দা, ঘি তেলসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু লুট করে ওই বাড়ির একটি কক্ষে বোঝাই করতো। কাশিমনগর হাট ও এলাকা থেকে পছন্দের গরু ছাগল ধরে আনতো। রাজাকারদের বাদশাহী কায়দায় খানাপিনা তৈরি ও আপ্যায়নের কাজে চারজন বাবুর্চি ছিল।
প্রথমদিকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের, তারপর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা ও নির্যাতন করতো। ক্যাম্প স্থাপনের পর প্রথমেই তারা ডা. ফণিভূষণ নাথ, উমাপদ দে ও চৈতন্য মল্লিককে ধরে এনে কপিলমুনি বাজারের ফুলতলা নামক স্থানে কপোতাক্ষ নদের ঘাটে হত্যা করে পানিতে ভাসিয়ে দেয়। বহু হিন্দুকে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে। যখন তখন যাকে তাকে ধরে এনে ইচ্ছামতো হত্যা করতো। স্থানীয় মুসলিম লীগ ও শান্তি কমিটির সদস্যদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী তারা এলাকার বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতো, হিন্দু নারীদের ধরে এনে ধর্ষণ করে হত্যা করতো। রাজাকার কমান্ডার নারীদের ভোগ করার পর অন্য রাজাকাররা ভোগ করতো।
ঐ ক্যাম্পে ৬টি কক্ষ নির্ধারিত ছিল ধর্ষণ ও অত্যাচারের জন্য। অনেক নারীকে ধর্ষণের পর পেট চিরে নদীর পানিতে ফেলে দিত। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে রতœা নামের একটি মেয়েকে সারারাত অত্যাচার করার পর তাকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিলে তার ভাসমান লাশ দেখে স্থানীয় মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
সুরক্ষিত দুর্গে বসে চলতো তাদের অত্যাচার। জোর করে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী আনা তাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। এলাকাটিতে হিন্দুদের বসবাস বেশি থাকায় তাদের ওপর চলতো অমানবিক নির্যাতন, ধন-সম্পদ লুট এমনকি জোর করে তাদের অনেককেই ধর্মান্তরিত করা হতো। হত্যা করা হয় শত শত মানুষকে। লালসার শিকার হন অগণিত মা-বোন। তাদের নির্যাতনের মাত্রা এতটা ভয়াবহ ছিল যে, আজো সে দিনের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকেই গা শিউরে ওঠেন। মানুষ ধরে দেয়ালে পেরেক দিয়ে শরীর গেঁথে রাখা হতো। হাত-পা কেটে ছিটানো হতো লবণ। এমনকি বড় বড় ইট দিয়ে শরীরে আঘাত করে হত্যা করা হতো। নির্যাতন করে হত্যার পর গোপন সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে লাশ পাশের কপোতাক্ষ নদে ফেলে দেয়া হতো। এই ক্যাম্পের রাজাকাররা খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করেনি। তারা ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন বের হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে গিয়ে গ্রামের নিরীহ মানুষকে ধরে এনে অত্যাচার করতো। এলাকার উঠতি বয়সের যুবতী মেয়েদের ধরে এনে ক্যাম্পে অত্যাচার করা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে পড়েছিল। রাজাকাররা হিন্দু আর বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতো। রাজাকার বাহিনীর আগমনের সংবাদ শুনলে এলাকার নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, যুবক সবাই পালিয়ে যেত।
এই কপিলমুনিকে স্বাধীন করতে স. ম আলাউদ্দীনের অবদান চিরস্মারণীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের যে কয়েকজন সদস্য সরাসরি অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলেন তাদেরই অন্যতম স. ম আলাউদ্দীন। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৬৭ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ২৯৮ জন নির্বাচিত সদস্যের প্রায় সকলেই ভারতে চলে যান। এরমধ্যে ৯ জন সদস্য অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স. ম আলাউদ্দীন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ভারতে বিহার প্রদেশে চাকুলিয়ার সিএনসি বিশেষ টিমে ৬ সপ্তাহের যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ঐ বিশেষ টিমে তিনিসহ ১৪জন এমএনএ, এমপি এবং ৩ জন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া ও বরিশাল নিয়ে এফ সেক্টর গঠিত হয়। এফ সেক্টর কমান্ডার ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। আমির হেসেন আমুর দায়িত্ব ছিল বনগাঁ থেকে বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে ছেলেদের বাছাই করা। আমির হেসেন আমুর পক্ষে স. ম আলাউদ্দীন ভারতের বসিরহাটে একটি হোটেলে রিক্রুটিং অফিস করেন। তিনি বাগু-িয়া ও ইটিন্ডা ক্যাম্পে নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নিয়োজিত হন। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে টাকি, তকিপুরসহ বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ছেলেদের খোঁজ খবর নিতেন। তিনি নেতৃস্থানীয় ছেলেদের তাদের নিজস্ব সীমান্তে গিয়ে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। মুজিব বাহিনীর কয়েকটি গ্রুপের ট্রেনিং শেষ হয়ে যাওয়ায় পর সাতক্ষীরা মহকুমার বিপুল সংখ্যক গেরিলা নিয়ে তিনি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। কপিলমুনি থেকে নয় কিলোমিটার দূরে তালা থানার মাগুরা ইউনিয়নের মাদরা গ্রামে ছিল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর একটি শক্তিশালী কমান্ড এই গ্রামটি নিরাপদ জেনে ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। কমান্ডার ছিলেন খুলনা জেলার মুজিব বাহিনী উপপ্রধান ইউনুস আলী ও তালা থানা মুজিব বাহিনীর প্রধান মোড়ল আব্দুস সালাম। দুইজনই ভারতের দেরাদুন থেকে বিশেষ গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত। দুই কমান্ডারের একান্ত প্রচেষ্টায় দুই মাসের মধ্যে তালা থানার ১২টি ইউনিয়নে দুই শতাধিক গেরিলা যোদ্ধা তৈরি হয়। গেরিলাদের অস্ত্র সরবরাহ করেন মুক্তিযোদ্ধা ও বৃহত্তর খুলনা জেলার মুজিব বাহিনী প্রধান কামরুজ্জামান টুকু ও তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য স. ম আলাউদ্দীন।
রাজাকারদের প্রধান কাজ ছিল এলাকা থেকে সুন্দরী যুবতী মেয়েদের ধরে আনা ও তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালানো। নারী নির্যাতনের কক্ষের পাশে একটি ছোট রুমে আওয়ামী লীগ কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে শারীরিক অত্যাচার করে গোপন তথ্য বের করার টর্চারিং সেল ছিল। নির্যাতনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের রুমের দেয়ালের সাথে হাতে, পায়ে, মাথায় ও বুকে বড় বড় লোহার পেরেক বিদ্ধ করে নির্মমভাবে খুন করতো। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধা রুস্তমের দেহ পেরেকবিদ্ধ অবস্থায় দেওয়ালের গায়ে পাওয়া যায়।
রাজাকারদের অপারেশন ডায়েরি থেকে জানা যায়, ১৪শ’ ১৩ জন মানুষকে তারা খুন করেছিল। রাজাকারদের আগ্নেয়াস্ত্র বলতে রাইফেল ছাড়া আর কিছু ছিল না। তবে টিন দিয়ে বড় ব্যারেল তৈরি করে কালো রঙ করে কামানের মতো ডামি কামান বানিয়ে ছাদের উপর পেতে রেখেছিল। ছাদের উপর বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার করা ছিল। মনে হতো ছাদের উপর কামান পাতা আছে, বাইরে থেকে দেখে সবাই দারুণ ভয় পেতো।
মুক্তিযোদ্ধারা সেখানকার রাজাকারদের বিরুদ্ধে আগেও দু’তিনবার লড়াই করেছে; কিন্তু তাদের হারাতে পারেনি। মুক্তিবাহিনী ১১ জুলাই কপিলমুনিতে প্রথম আক্রমণ চালায়। আরেকবার তালা থানার বাম সংগঠনসমূহের সমবেত চেষ্টায় রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করা হয়। কিন্তু পর পর দুটি আক্রমণে আশানুরূপ ফল না হওয়ায় রাজাকারদের মনোবল বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই শত্রু মনে করে যে কোনো লোককে রাজাকাররা প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে ক্ষমতার দাপট প্রকাশ করতো। এক পর্যায়ে তাদের অত্যাচারে এলাকার মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে।
রাজাকারদের অত্যাচারের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, এলাকার মুক্তিযোদ্ধাগণ এই ক্যাম্প ধ্বংস করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কপিলমুনির এ শক্ত রাজাকার দুর্গ আক্রমণের জন্য তৈরি করা হয় মহাপরিকল্পনা। এবার আঁটসাঁট বেঁধেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হয়। আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয় এলাকার বিভিন্ন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয় করে। সংকল্প হয় ঐ ঘাঁটির পতন না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের। কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প পতনের এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মুজিব বাহিনীর খুলনার উপপ্রধান ইউনুস আলী, নৌ কমান্ডো দলের লে. রহমতউল্লাহ, স. ম বাবর আলী, লে. শামসুল আরেফিন, স. ম আলাউদ্দীন, ইঞ্জিনিয়ার মুজিবুর রহমান প্রমুখ। এদের নেতৃত্বে খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন থানার কয়েকশ’ মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে অংশ নেন।
৭১ এর ২০ নভেম্বর কপিলমুনি যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন কমান্ডার ইউনুস আলী ও মোড়ল আব্দুস সালাম। এই পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান, সামছুর রহমান, জয়নুল, সুভাষ সরকার, মকবুল ইসলাম, নির্মল পাল, আবু বকর মোড়ল, শরিফুল ইসলাম ও আব্দুর রাজ্জাক। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রধান নেতৃবর্গ ও কমান্ডারদের সমন্বয়ে এক জরুরী বৈঠক আহবান করা হয়। মাগুরার প্রখ্যাত জমিদার অজয় রায় চৌধুরী ওরফে ঝুনু বাবুর দোতলায় রুদ্ধদার বৈঠক হয়। আলোচনায় কপিলমুনি যুদ্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ তারিখ নির্ধারণ করা হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু, স. ম বাবর আলী, স. ম আলাউদ্দীন, সুভাষ সরকার, মুজিবর রহমান, সামছুর রহমান, মাস্টার সুজাত আলী, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। উক্ত বৈঠকে মূল ভূমিকায় ছিলেন কমান্ডার ইউনুস আলী ইনু ও মোড়ল আব্দুস সালাম। রাজাকারদের অস্ত্র ও জনবল সম্পর্কিত গোপন সংবাদ সরবরাহের দায়িত্ব প্রদান করা হয় সরদার ফারুক আহম্মদ ও চেয়ারম্যান নুর খাঁর উপর। কপিলমুনি যুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তানি নৌ-বাহিনীর লে. গাজী রহমত উল্লাহ দাদুকে প্রধান কমান্ডার নির্ধারণ করা হয়। তার নির্দেশে যুদ্ধ চলবে এবং যুদ্ধ শেষ হবে। ব্যতিক্রম হলে রেহাই পাবে না কোনো মুক্তিযোদ্ধা। দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুজিব ও মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত কমান্ড। সকলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কপিলমুনির রাজাকার বাহিনীকে সমূলে নিধন করে তবেই ফিরবে। কপিলমুনিতে বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়ির মূল ভবনের দেয়াল ছিল ২০ ইঞ্চি গাঁথুনির আর সীমানা প্রাচীর ছিল ১৫ ইঞ্চির। এরপরও রাজাকাররা তাদের ঘাঁটির নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য বড় বড় সুন্দরী গাছ দিয়ে একটি প্রাচীর গড়েছিল। বিল্ডিংয়ের ছাদের চারকোণে চারটি বাঙ্কার তৈরি করেছিল রাজাকাররা। উপর থেকে অনেক দূর পর্যন্ত গুলি চালানো যেত। সব মিলিয়ে ভবনটি এতই সুরক্ষিত ছিল যে, সেখানে আক্রমণ চালানো অত্যন্ত দুরূহ ছিল। এ কারণে এমনভাবে পরিকল্পনা সাজানো হয় যাতে রাজাকারদের পরাজয় নিশ্চিত হয়।
পাটকেলঘাটা ব্রিজের পাশে খানসেনাদের ঘাঁটি ছিল। আর গ্রামে ছিল তাদের রাজাকার গোয়েন্দাবাহিনী। কখন কে যুদ্ধে যাচ্ছে এই খবর তাদের কানে পৌঁছালে পাটকেলঘাটায় তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো এবং সেখানে তাদের হত্যা করা হতো। মাগুরা গ্রামের অজয় রায় চৌধুরী ওরফে ঝুনু বাবু ও তার ১৫ জন সঙ্গী ভারতে ট্রেনিং এর জন্য যাচ্ছিল। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ইসলামকাটি পৌঁছানো মাত্র রাজাকারদের আল শামস বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তাদের সবাইকে পাটকেলঘাটা ডাক বাংলায় নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চাঁদকাটী গ্রামের করিম গাজীকে এভাবে মারা হয়।
৫ ডিসেম্বর ৯ নম্বর সাব সেক্টর কমান্ডার লে. কমান্ডার রহমতউল্লাহ্ দাদু ভাইকে প্রধান ও স. ম. বাবর আলী, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, ইউনুচ আলী, স. ম আলাউদ্দীন, আবুল কালাম আজাদকে কপিলমুনির যুদ্ধে সহনেতৃত্ব প্রদান করা হয়। পাইকগাছা থানার কাটিপাড়া ক্যাম্পে লে. কমান্ডার রহমতউল্লাহ্ দাদু ভাই উপস্থিত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রিফিং করেন। অন্যদিকে তালা থানার মাদরা ক্যাম্পে ইউনুচ আলী ব্রিফিং করেন।
কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল চতুর্মুখী। কপিলমুনি যুদ্ধে পরিকল্পনানুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা ৬ ডিসেম্বর ১০ জন কমান্ডারের নেতৃত্বে ১৮টি দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন পথে রাত ১২টায় মাগুরা থেকে কপিলমুনিতে রওনা দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে রাইফেল, এসএলআর মর্টার, অটোমেটিক রাইফেলসহ প্রচুর গোলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। সিদ্ধান্ত ছিল শেষ রাতে মর্টারের গোলা নিক্ষেপের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হবে। কিন্তু কমান্ডার স. ম বাবর আলীর গ্রুপ সোনাতনকাটী খেয়া পার হয়ে নাসিরপুর ব্রিজের সন্নিকটে পৌঁছালে ১৪ জন ডিউটিরত রাজাকারের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ মাঠের সংকেত দ্বারা অভিহিত করা হয়। কিন্তু শত্রু পক্ষের লোক বিধায় সংকেতের জবাব দিতে ব্যর্থ হলে স. ম বাবর আলীর হাতে এলএমজির ব্রাশ ফায়ারে ১৪ জন রাজাকার ঘটনাস্থলে নিহত হয়। এই ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ অসুবিধা ও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। যদিও তাতে কোনো আত্মঘাতি ঘটনা ঘটেনি।
পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে জলে ও স্থলে পাহারায় বসানো হয়, যাতে রাজাকারদের সহায়তার জন্য কোনো পাকিস্তানি সেনা না আসতে পারে। মূল ঘাঁটির পশ্চিম দিকে বেড়িবাধের পাশে নৌ কমান্ডোরা অবস্থান নেয়। ঐ দিন দিবাগত রাতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। রাত ১২টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা যার যার অবস্থানে পজিশন গ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা হরিঢালী স্কুল, কপিলমুনি গার্লস স্কুল, কপিলমুনি বিদ্যামন্দির, নদীর ওপার কানাইদিয়া, গোলাবাড়ী স্কুলসহ বিভিন্ন স্থানে রাজাকার ক্যাম্প ঘিরে অবস্থান গ্রহণ করেন। রাত ৪টার দিকে দাদু ভাই এসএমজি দিয়ে ফায়ার ওপেন করেন। রাজাকার ক্যাম্প লক্ষ করে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি শুরু করেন। রাজাকাররাও বাঙ্কার থেকে গুলি করতে থাকে।
মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে সাড়াশি আক্রমণ শুরু করে রাজাকারদের মূল ঘাঁটিতে। ডিনামাইট দিয়ে কপিলমুনি ও তালার মধ্যবর্তী কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়া হয়। রাস্তায় মাইন বসিয়ে গেরিলারা এম্বুশ পেতে রাখে। টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়। পাকসেনারা এসে যাতে কপিলমুনির রাজাকারদের সহায়তা করতে না পারে সেজন্য কানাইদিয়া গ্রামের রাস্তার কালভার্ট উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। স. ম আলাউদ্দীনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল অবস্থান নেয় রাস্তার পাশে তৈরি করা পরিখায়। তাদের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা আসছে বুঝতে পারলে কালভার্ট উড়িয়ে দেয়া। এই স্থানে কার্ট অফ পার্টির কমান্ডার ছিলেন স. ম আলাউদ্দীন। তবে পাকিস্তানি সৈন্যরা না আসায় সেটার প্রয়োজন পড়েনি।
৬ ডিসেম্বর ভোর হয়। এই দিন ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে মুক্তিযোদ্ধারা নতুন করে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পান। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির সংকট দেখা দিলে কমান্ডারগণ ভারত থেকে গুলি এনে সেই চাহিদা পূরণ করেন। রাজাকাররা ক্যাম্পে আটক থেকে মাঝেমধ্যে গুলি করতে থাকে। বিরামহীন যুদ্ধ চলতে থাকে। তবে আরসিএল এর শত শত গোলা নিক্ষেপ করেও রাজাকার দুর্গের একটি ইটও খসানো যায়নি। এমতাবস্থায় যুদ্ধ শুরুর পরের দিন মাইকে রাজাকারদের নির্দিষ্ট সময় বেধে দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। কিন্তু তার জবাবে তারা আত্মসমর্পণ না করে বাড়ির ভিতর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে অশ্রাব্য গালিগালাজ ও আত্মসমর্পণ করতে বলে। এমনকি রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন প্রকার হুমকি প্রদানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিতে থাকে। এ ঘোষণা শুনে মুক্তিযোদ্ধাদের মেজাজ চরমে উঠে যায়। তারা আমরণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।
একইভাবে ৭ থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ক্যাম্পের মধ্যে অবস্থান করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আত্মসমর্পণ করতে বার বার মাইকযোগে আহ্বান জানানো সত্ত্বেও তারা আত্মসমর্পণ করেনি। ক্যাম্পের মধ্য থেকে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে থেমে থেমে গুলি করতে থাকে। রাজাকারদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে এলে বাঁচার কোনো পথ নেই দেখে রাজাকাররা দুর্বল হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে স. ম আলাউদ্দীন ভারত থেকে মর্টার ও প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে আসছে জানতে পেরে রাজাকারদের মনোবল আরো ভেঙে পড়ে।
রাজাকারদের বাইরের সহায়তা পাওয়ার সব আশা শেষ হয়ে গেলে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে গেলে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত হয়। ৯ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় তারা আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা একে একে সব রাজাকারকে ক্যাম্প থেকে বের করে আনেন। ক্যাম্পের মধ্যে চার জন বীরাঙ্গনাকে পাওয়া যায়। তাদের আটকে রেখে রাজাকাররা অমানুষিক নির্যাতন করেছে। তালার মাছিয়াড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আলী গাজীকে দেওয়ালের সঙ্গে পেরেক দিয়ে বিদ্ধ অবস্থায় ক্যাম্পের মধ্যে পাওয়া যায়। রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করলে এলাকার মানুষ ‘জয়বাংলা’ বলে একত্রিত হয় স্কুলের মাঠে। হাজার হাজার উত্তেজিত জনতা রাজাকারদের মেরে ফেলার দাবি করে। যে যেভাবে পেরেছিল আক্রমণ করেছিল রাজাকারদের ওপর। তারা রাজাকারদের মৃত্যুদ- দাবি করতে থাকে। স্বজনহারা লোকজন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে ওঠে। জনগণের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ একত্রিত হয়ে রাজাকারদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এলাকার মানুষের দাবি অনুযায়ী গণ-আদালত গঠন করে তাদের মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়। ১৫১ জন (ভিন্ন মতে ১৫৬ রাজাকার) রাজাকারের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি অত্যাচার করেছে, তাদের আলাদা করে এবং অন্যদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। যা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ইতিহাসে ব্যতিক্রমধর্মী অধ্যায়। বাস্তবায়িত হয় গণআদালতের রায়। কপিলমুনি যুদ্ধে দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। বাজারের প্রধান সড়ক পার হতে গিয়ে রাজাকারদের গুলিতে কেয়ারগাতির আনসার আলী ও খুলনার আনোয়ার শহিদ হন। আগরঘাটার মুক্তিযোদ্ধা তোরাব আলী আহত হন। এই ক্যাম্প পতনের পর সেখান থেকে প্রাপ্ত কাগজপত্র থেকে জানা যায় রাজাকাররা ১৬০১ মতান্তরে ১৬১০ জনকে হত্যা করে। তবে জুন-জুলাই মাস থেকে শুরু করে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই দীর্ঘসময়ে এই বিশাল ঘাঁটি থেকে কমপক্ষে ৫ হাজার মানুষকে রাজাকাররা নির্মমভাবে হত্যা করে।
কপিলমুনি যুদ্ধের পরিকল্পনা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. গাজী রহমত উল্লাহ দাদু, স. ম বাবর আলী, ইউনুস আলী, স. ম আলাউদ্দীন, মোড়ল আব্দুস সালাম, সাহিদুর রহমান কুটু, আবুল কালাম আজাদ, গাজী রফিকুল ইসলাম, কামরুজ্জামান টুকু, রশীদ, মকবুল হোসেন, সামাদ মাস্টার, জিল্লুর রহমান, গাজী আনছার খালেক, মোশারফ, আবু জাফর, খোকা, জোয়াদ্দার রসুল বাবু, ইঞ্জিনিয়ার মুজিবুর রহমান, ফারুক সরদার, তোরাব, কাইয়ুম, বিনয়, তৌফিকসহ বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের অবদান চির স্মরণীয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীরসেনানী ও তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা স. ম আলাউদ্দীন ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তালা আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। তালার মাগুরা ও কপিলমুনি যুদ্ধে স. ম আলাউদ্দীনের অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অবদান চির স্মরণীয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, দৈনিক পত্রদূতের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নির্ভীক কলম সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ স. ম আলাউদ্দীনের প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
(তানজির কচি সম্পাদিত ও ম্যানগ্রোভ প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ দীপ্ত আলাউদ্দীন থেকে উদ্ধৃত)
