আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও একই সাথে সুন্দরবন দিবস। এই দিনে এক অপরের ভালোবাসার মানুষকে ফুল, চিঠি, কার্ড ও বিভিন্ন উপহার দিয়ে ভালোবাসা জানান। প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী উৎযাপিত হয় বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে পালিত হয় সুন্দরবন দিবস।
ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেইটাইন’স নামে একজন খৃষ্টান চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচারের-অভিযোগে তৎকালীন রোমান স¤্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাঁকে বন্দী করেন। কেননা তখন রোমান রাজ্যে খৃষ্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দী অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের জনপ্রিয়তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। সেই দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল।
অতঃপর পোপ সেন্ট জেলাসিউ ও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন’স স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস ঘোষণা করেন। এরপর থেকেই পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।
এদিকে, ২০০১ সালে প্রথম পালিত হয় সুন্দরবন দিবস। ২০০১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রূপান্তর ও পরশ এর উদ্যোগে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে আরো প্রায় ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠন অংশগ্রহণ করে। সম্মেলনে প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সুন্দরবন দিবস ঘোষণা করা হয়। আর তার পর থেকেই প্রতিবছর সমগ্র বাংলাদেশে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সুন্দরবন দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে।
ভালোবাসা দিবস যুগলদের মনের উচ্ছ্বাসকে বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। কেবলমাত্র তরুণ-তরুণী নয়, সকল বয়সের মানুষই ভালোবাসার এই দিনে একসঙ্গে সময় কাটায়। এই দিনটি পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হলেও ভ্যালেন্টাইনস ডে তে বাঙালিদের মনের ভালোবাসাও যেন পায় নতুন রূপ। নতুনভাবে প্রকাশিত হয় ভালোবাসার অনুরাগ। আজকের এ ভালোবাসা শুধুই প্রেমিক আর প্রেমিকার জন্য নয়। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, সন্তান এমনকি বন্ধুর জন্যও ভালোবাসার জয়গানে আবেগ আপ্লুত হয় সকলেই।
অনেকেই বিশ^াস করেন যে, এই ফেব্রুয়ারি মাসে পাখিরা তাদের নতুন জুটি খুঁজে বাসা বাঁধে। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে সবুজ প্রকৃতি।
পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। বিশ্ব ঐতিহ্যখ্যাত নয়নাভিরাম এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন আজ সময়ের পরিক্রমায় হুমকির মুখে পড়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৭ লক্ষাধিক পরিবার সরাসরি সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও প্রায় ২ কোটি মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ও জীবন-জীবিকা কমবেশী এর উপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে উপকূলীয় এ অঞ্চলের কৃষি পরিবেশ ও প্রতিবেশ। সুন্দরবন নির্ভর পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকার মান-উন্নয়ন ও সুন্দরবনের স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার জন্য সকলকে সুন্দরবন দিবসের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে।
রামসার ঘোষিত এই সুন্দরবনে ৫ হাজার প্রজাতির সম্পূরক উদ্ভিদ, ১৯৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১২৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৭৯ প্রজাতির পাখি, ১২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ৩০ প্রজাতির চিংড়ি মাছ রয়েছে। নানা বৈচিত্র্যময় সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। সুন্দরবনের বনজ, মৎস্য ও পর্যটন খাত থেকে প্রতিবছর প্রচুর পরিমানে রাজস্ব আয় হয়ে থাকে। প্রতিবছর দেশী বিদেশী বহু পর্যটক পাড়ি জমায় সুন্দরবনে। বাংলাদেশের সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা লাভ করা সম্ভব।
সুন্দরবনের মর্যাদা বিশ্বের দরবারে সমুজ্জ্বল রাখতে এবং সুন্দরবন সুরক্ষায় নানা ধরনের পরিবেশ বান্ধব পরিকল্পনা ও উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে। সুন্দরবন দিবসের মাধ্যমে সকলকে সুন্দরবন সুরক্ষায় সচেতন করতে হবে। র্যালি, আলোচনা, সেমিনার, মতবিনিময়, গোলটেবিল বৈঠক, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, স্বারকলিপি প্রদান, পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ এবং ডকুমেন্টরি প্রদর্শনীর মাধ্যমে সুন্দরবন সুরক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম ও স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুন্দরবন বিষয়ক রচনা, চিত্রাংকন, গল্প ও কবিতা প্রতিযোগিতা আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের মননশীল চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো যেতে পারে।
প্রকৃতির অফুরন্ত প্রাণ সম্পদে ভরা বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে সুরক্ষার জন্য সরকারি-বেসরকারি সকল মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। চিন্তা, চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে সুরক্ষা করতে হবে। তাহলে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদী ভাঙনের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে প্রাণ ও বৈচিত্র্য সুরক্ষা পাবে। শুধু বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে নয়, শুধু সুন্দরবন দিবসে নয় আমাদের বৈচিত্র্যেভরা প্রিয় সুন্দরবনকে ভালোবাসতে হবে আপন মহিমায়।
