ডেস্ক রিপোর্ট: জহির উদ্দিন আহমেদ, পুলিশের একজন উপপরিদর্শক (এসআই)। বর্তমানে দায়িত্বরত আছেন পল্লবী থানায়।
তার বিশেষত্ব- তিনি ‘শ্রেষ্ঠ মাদক উদ্ধারকারী’ পুলিশ সদস্য। ঝুলিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি পুরষ্কার। এ ছাড়া তিনি একে একে ‘শ্রেষ্ঠ বিস্ফোরক উদ্ধারকারী’, ‘শ্রেষ্ঠ চোরাই গাড়ি উদ্ধারকারী’ এসআই। তার টেবিলে শ্রেষ্ঠ হিসেবে অসংখ্য ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেটও রয়েছে।
মুদ্রার যেমন দুটি পিঠ, এসআই জহির উদ্দিনেরও দুটি মুখ। একদিকে তিনি পুলিশের শ্রেষ্ঠ সদস্য। অন্যদিকে ‘অর্থ খেকো’। শ্রেষ্ঠত্বের আড়ালে তার অপরাধ কর্মকাণ্ড অনেক। এমনটাই দাবি অনেকের।
বিষয়টি সামনে আসে সোমবার (২৪ জুলাই) রাতে পল্লবীর ১১ নম্বর আদর্শ নগরে পুলিশের অভিযানে বৈশাখী নামে এক তরুণীর আত্মহত্যার ঘটনার পর। এসআই জহিরসহ ৩ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তিন লাখ টাকা দাবির অভিযোগ তুলেছে নিহতের পরিবার। ভুক্তভোগীদের দাবি, টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে বৈশাখীর সামনে তার মা লাভলীকে নির্যাতন করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর তিনতলার একটি ঘরে বৈশাখীর ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়। ঘরটি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ ছিল।
এ ঘটনায় পুলিশের একটি বিশেষ শাখার প্রতিবেদনে এসআই জহির উদ্দিনসহ তার টিমের ৩ সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে একটি গোপন প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। এতে বলা হয়, ঘটনার দিন জহির ও তার টিমের লোকজন সোর্স (পুলিশের ফর্মা) পাঠিয়ে লাভলীর কাছে ৩ লাখ টাকা দাবি করেন। তিনি টাকা দিতে না চাইলে পুলিশ তাকে থানায় নিতে চায়। এ সময় লাভলীর মেয়ে বৈশাখী তার মাকে ছেড়ে না দিলে আত্মহত্যার হুমকি দেয়।
গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, এসআই জহির ও তার টিমের সদস্যরা মাদক কারবারিদের আটক ও মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে মাদকের আস্তানায় হানা দিয়ে টাকা আদায় করেন। প্রত্যেক আস্তানা থেকে তারা সপ্তাহে ৫-৬ হাজার টাকা নেন। মাদকের আস্তানাগুলো হলো- পল্লবীর ১২ নম্বর কালশী কবরস্থান, সাংবাদিক আবাসিক এলাকার আশপাশ এবং ২২তলা গার্মেন্টসের চিহ্নিত স্থান। এগুলো ফতুর স্পট, জসিমের মায়ের স্পট, লিটনের বাংলা মদের স্পট, আদর্শ নগরের লাভলীর স্পট নামে পরিচিত।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একই থানায় দীর্ঘদিন চাকরির সুবাদে স্থানীয় মাদক কারবারিদের সঙ্গে জহিরের টিমের সদস্যরা সখ্য হয়। ফলে মাদক নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে সাধারণ জনগণ পুলিশের প্রতি বিরূপ ধারনাসহ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখে পড়ছে।
ওই প্রতিবেদনে এসআই জহির ছাড়াও তার টিমের দুই সদস্য ও কয়েকজন সোর্সের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন- সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ফেরদৌস, কনস্টেবল মো. মেসবাহ উদ্দিন। সোর্সরা (ফর্মা) হলেন- ওয়াহিদ, আমিনুল ইসলাম টিটু, সোলেমান, হিল্লোল ও মোশারফ।
সরেজমিন পল্লবীর মাদক আস্তানা ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেউ বিপুল পরিমাণ মাদক নিয়ে ধরা পড়লে তাকে অল্প মাদক দিয়ে মামলা দেন এস আই জহির। আর অবশিষ্ট মাদক সোর্সের (পুলিশের ফর্মা) মাধ্যমে বিক্রি করে দেন। অল্প পরিমাণ মাদক দিয়ে মামলা দেওয়ার জন্যও আসামির কাছ থেকে টাকা নেয় পুলিশ। এ ক্ষেত্রে জামিনে সুবিধা পেতে আসামিরাও টাকা লেনদেন করেন।
সাইমন নামে পল্লবী থানা পুলিশের এক সোর্স জানান, এসআই জহিরের সোর্সের খাতায় নাম উঠিয়েছেন এমন অনেকেই মাদক মামলার আসামি ও মাদক বেচাকেনায় জড়িত। এর মধ্যে সোর্স আমিনুল, ওয়াহিদ, সোলেমান ও তার স্ত্রী টুম্মা, নজু, রাইটার নাসির, পাতা সোহেল, দাঁত ভাঙা মামুন ও আরজু সরাসরি ইয়াবা বেচাকেনা করে। সোর্সদের সামারির (টাকা খেয়ে ছেড়ে দেওয়া) ভয়ে স্থানীয় মাদক কারবারিরা সব সময় আতঙ্কে থাকেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশ কয়েক মাস আগে মিরপুর ১২ নম্বর কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক কারবারি শফিক ও সারাফাতকে সাভার থেকে ৬ হাজার ইয়াবাসহ আটক করেন এসআই জহিরের লোকজন। এরপর ৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা আদায় করে ওই আসামিদের অল্প পরিমাণ মাদক দিয়ে চালান দেওয়া হয়। চলতি বছরের মার্চে পল্লবীর ১১ নম্বর বাউনিয়া বাঁধে ইয়াসমিন নামে এক নারীকে ৮ কেজি গাঁজাসহ আটক করেন জহির। ওই নারীর কাছে ৪০ হাজার টাকা আদায় করে ২০০ গ্রাম গাঁজা দিয়ে মামলা দেয় পুলিশ।
গত রমজানে সাভারের আকরাইন থেকে মিরপুর ১১ নম্বর এডিসি ক্যাম্পের চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ল্যাংড়া রুবেলের দুই সহযোগীকে ৯ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক করে জহিরের টিম। এরপর পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে সামান্য মাদক দিয়ে আসামিদের মামলা দেওয়া হয়।
বাউনিয়াবাঁধের বাসিন্দা ও আগে পুলিশের সোর্স ছিলেন এমন এক ব্যক্তি জানান, ৬-৭ মাস আগে কালশী কবরস্থানের পেছনের গলি জসিমের মার মাদক স্পটে শাহিনুর নামে এক নারীকে ১ কেজি গাঁজাসহ আটক করে এসআই জহিরের লোকজন। ওই সময় তার কাছে ১ লাখ টাকা আদায় করে ৩০০ গ্রাম গাঁজা দিয়ে মামলা দেওয়া হয়। ছয় মাস আগে পল্লবীর শীর্ষ মাদক কারবারি মওলা কবিরের স্ত্রী পিংকি আক্তারকে উত্তরা থেকে ধরে এনে ২ লাখ টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে পুলিশের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
পল্লবী থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্য জানান, থানা এলাকায় এসআই জহির খুব দাপট নিয়ে চলেন। নিজেকে তিনি পুলিশের এক ডিআইজির আপন ভাতিজা বলে পরিচয় দেন। এ জন্য অনেক পুলিশ কর্মকর্তা তাকে সমীহ করে চলেন। থানার অনেকে টিম (হোন্ডা ডিউটি) চালানোর সুযোগ না পেলেও ডিআইজির আত্মীয় পরিচয়ে টিম চালিয়ে দুই হাতে টাকা কামান জহির।
এসআই জহিরের বিরুদ্ধে কয়েকজন ভুক্তভোগী ডিএমপি কমিশনারসহ পুলিশের আইজিপির কাছে ছয়টিরও বেশি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগের কয়েকটি কপি আছে বাংলানিউজের হাতে।
এসব ব্যাপারে প্রশ্ন করলে এসআই জহির উদ্দিন বাংলানিউজকে সোজা সাপটা উত্তর দেন। তিনি বলেন, পল্লবী থানা এলাকা থেকে কোনো মাসোয়ারা পাইনা। এগুলো মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে কাজ করায় একটি সিন্ডিকেট আমার বিরুদ্ধে কাজ করছে।
এ ব্যাপারে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহা. মাহফুজুর রহমান মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, দুষ্ট গরুর থেকে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপরাধী যে-ই হোক সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে মন্তব্য করেন মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. জসীম উদ্দীন মোল্লাও।
সূত্র: বাংলানিউজ
