বিলাল হোসেন, উপকূলীয় প্রতিনিধি: শনিবার (২১ ডিসেম্বর) সকাল ৯টা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এমন সময় শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ বাজারে কথা হয় দুইজন মানুষের সাথে। যাদের গায়ে ছিল জাম্পার, গলায় মাপলার। দুইজনের হাতে দুইটা ব্যাগ। কাপড়চোপড়সহ শরীরে লেগে ছিল সুন্দরবনের কাদামাটি। কৌতূহলবশত কোথা থেকে এসেছেন? জিজ্ঞাসা করার সাথে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা।
কান্না জড়িত কণ্ঠে জানান, গত ১৪ ডিসেম্বর সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের কদমতলা স্টেশন থেকে পাশ নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেছিলেন তারা। ১৫ ডিসেম্বর সুন্দরবনের পুষ্পুকাটি এলাকার মাটে নদী থেকে কাঁকড়া মারার সময় বনদস্যু মজনু বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিপণের দাবিতে তাদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে তাদের উপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। এক সপ্তাহের বেশি সময় আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে। পরে দুইজন এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তি পায়। বনদস্যু মজনু বাহিনীর সদস্য আলিফ দাতিনাখালির এক জেলের নৌকায় তাদের উঠিয়ে দিয়ে বুড়িগোয়ালিনীতে নামিয়ে দিতে বলে।
সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে আর নিজেদের নাম বলতে চাননি তারা। পরবর্তীতে নাম জানালেও পুনরায় বনদস্যুদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে নাম না প্রকাশের অনুরোধ করেন মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা এই দুই জেলে। তাদের বাড়ি শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের হরিনগর গ্রামে।
শুধু এই দুই জেলে নয়, ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর থেকে অদ্যাবধি সুন্দরবনে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বনদস্যুরা। প্রতিনিয়তই জেলেদের জিম্মি করে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দিচ্ছে। সময় মতো মুক্তিপণ না দিতে পারলে জেলেদের উপর চালাচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে জানান, বনদস্যুদের সাথে সবসময় ফোনের মাধ্যমে লোকালয়ের কিছু মানুষ যোগাযোগ করছে। কখন কোন নৌকা নামছে, কোন এলাকায় যাচ্ছে, তার তথ্য চলে যাচ্ছে বনদস্যুদের কাছে। প্রশাসন চাইলেই মুক্তিপণ আদায়ের বিকাশ নাম্বার ট্রাকিং করে তাদের সনাক্ত করা সম্ভব হলে জানান তারা।
জানা গেছে, গত ১৭ ডিসেম্বর ৩ জেলেকে অপহরণ করে বনদস্যুরা। অপহৃত জেলেরা হলেন, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হরিনগর গ্রামের নাজির সরদারের ছেলে রেজাউল ইসলাম (৩৮), গোলাম মোস্তফার ছেলে সুজন গাজী (২৭) ও খুলনার কয়রা উপজেলার দশালি গ্রামের শের আলী মোল্লা ওরফে কবিরাজের ছেলে এমদাদুল হক (৩৩)।
গত ৮ নভেম্বর সুন্দরবনের মালঞ্চ নদের সাতনলা দুনে এলাকায় মাছ ধরার সময় অস্ত্রধারী বনদস্যু বাহিনীর হাতে জিম্মি হন খুলনার কয়রা উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের আতাহার হোসেন (৩৫) ও রফিকুল ইসলাম (৩৮)।
মাছ কোম্পানি আব্দুল্লাহ আল মামুনের মোবাইল ফোনে বনদস্যু জিয়া বাহিনীর পরিচয় দিয়ে নৌকা প্রতি বছরে এক লাখ চাঁদা দিয়ে নদীতে মাছ ধরতে নামার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিভিন্ন থানায থেকে লুট হওয়া অস্ত্র নিয়ে জেল পলাতক আসামিরা সুন্দরবনে দস্যুতায় নেমেছে। আত্মসমর্পণকৃত বনদস্যু মজনু বাহিনীর মজনুসহ অন্যান্য সদস্যরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা সুন্দরবনে। সম্প্রীতি খুলনার লবণচরা থেকে বনদস্যু মজনু বাহিনীর কাছে অস্ত্র পাচারের সময় গ্রেপ্তার হয়েছে হরিনগর গ্রামের শহিদুল ইসলামসহ এক নারী।
মজনু বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়েছেন আত্মসমর্পণকৃত বনদস্যু আলিফ ওরফে (দয়াল), মিলন পাটোয়ারীসহ একাধিক সদস্য।
মজনু বাহিনীর পাশাপাশি নতুন করে বনদস্যুতায় নেমেছে সুন্দরবনের একসময়কার আতঙ্ক, কয়রা গ্রামের জিয়াবাহিনীর প্রধান জিয়াউর রহমান। দস্যুতার মামলায় জেল থেকে জামিন নিয়ে ফের বনদস্যুতায় নেমেছেন তিনি।
বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়।
বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া সুন্দরবনসংলগ্ন ভেটখালী গ্রামের জেলে নজরুল ইসলাম জানান, ৩১ অক্টোবর সকালে সুন্দরবনের ধানুখালী এলাকা থেকে মঞ্জুর বাহিনী পরিচয়ে ডাকাতেরা তাঁকে অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা দিতে আপত্তি করায় আটকে রেখে বেদম মারপিট করা হয়। ৩ নভেম্বর সকালে সুন্দরবনের তক্কাখালী এলাকায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালাতে গেলে দস্যুরা বন বিভাগের সদস্যদের লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। জবাবে বনকর্মীরাও পাল্টা গুলি ছোড়েন। এ সময় প্রতিরোধের মুখে বনদস্যুরা পালিয়ে যান। ঘটনাস্থল থেকে অপহৃত ১০ জেলে, ৩টি নৌকা, ১টি সোলার প্যানেল ও ১টি গুলি উদ্ধার করা হয়।
এদিকে, সুন্দরবন জুড়ে দস্যুতা শুরু হওয়ায় জীবন-জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন জেলেরা। অনেকেই পেশা বদলে ইটভাটায় কাজ করতে চলে গেছেন। আবার অনেকে বনদস্যুদের চাঁদার টাকা ম্যানেজ করতে না পেরে সুন্দরবনে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মশিউর রহমান জানান, সুন্দরবন থেকে বনদস্যু নির্মূল করতে টহল বাড়ানো হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের সাথে কথা হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুন্দরবনে বনদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। আমরা সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যাতে জেলেরা বনদস্যুদের দ্বারা হয়রানি না হয়।
